আমাদের দেশে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে ঈদ। আর ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ মানেই নানা ধরনের রেড মিট বা লাল মাংসের আয়োজন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ থাকে গরুর মাংস। এটি বেশিরভাগ মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে। অনেকেই খুব বেশি পরিমাণে খেয়ে ফেলেন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। আবার অনেকেই ক্ষতিকর ভেবে খেতে চান না। আসলে প্রতিটি খাবারেরই ভালো এবং খারাপ দিক নির্ভর করে কতটুকু খাওয়া হচ্ছে এবং কিভাবে খাওয়া হচ্ছে সেটির ওপর।
তাই গরুর মাংস কতটুকু খাবেন, এর ভালো, খারাপ দিক এবং ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে খাওয়ার উপায়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করব-
গরুর মাংস কতটুকু খাবেন:
জেনে অবাক হবেন গরুর মাংস পরিমিত পরিমাণে সঠিক নিয়ম মেনে খেলে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ওজন নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে অনেক বেশি উপকার পাওয়া সম্ভব যা অন্য অনেক খাবার থেকে পাওয়া যায় না।
সাধারণত একজন সুস্থ মানুষ একদিনে রান্না করা চর্বি ছাড়া ৩ আউন্স বা ৮৫ গ্রামের মতো মাংস খেতে পারেন। এতে ক্যালরির পরিমাণ থাকে ১৭৩ এবং প্রোটিন থাকে প্রায় ২৫ গ্রামের মতো। গরুর মাংস মানেই হাই ক্যালোরি তা নয়। এটি আমাদের সারা দিনের প্রোটিনের চাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশের মতো পূরণ করে ফেলতে সক্ষম। তাই মাসে ৭/৮ বার খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু স্বাস্থ্যকর খাবারের বৈচিত্র্য আনতে এবং সব ধরনের পুষ্টিমূল্য পেতে অন্য সব খাবার খেতে হলে ৪/৫ দিনের বেশি না রাখলেই ভালো।
অনেকেই ভাবেন গরুর মাংসে সবচেয়ে বেশি কলস্টেরল রয়েছে কিন্তু দেখা যায় একটি মুরগির ডিমের কুসুমে ১৯০ মিলিগ্রাম ভালো কলস্টেরল থাকে অথচ চর্বি ছাড়া ৩ আউন্স বা ৮৫ গ্রাম গরুর মাংসে থাকে মাত্র ৭৭ মিলিগ্রাম। একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক কলস্টেরলের নিরাপদ মাত্রা হচ্ছে ৩০০ মিলিগ্রাম এবং হৃদরোগীদের জন্য ২০০ মিলিগ্রাম। তাই গরুর মাংস মানেই অনেক বেশি কলস্টেরল এই ধারণা ভুল।
গরুর শরীরের ২টি অংশে চর্বির পরিমাণ সবচেয়ে কম থাকে। অংশেগুলো হচ্ছে রানের ফোলা দিক বা রাউন্ড এবং পেছনের দিক অংশের লয়েন/সিরলয়েন অংশে। তবে কেউ যদি ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হাইপার টেনশন বা কিডনি রোগে আক্রান্ত হন তাহলে চিকিৎসকের কাছে মাংস খাওয়ার পরিমাণটি জেনে নেয়া উচিত।
গরুর মাংসের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা:
গরুর মাংসে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় প্রায় সব পুষ্টি উপাদান পাওয়া সম্ভব। এ থেকে প্রোটিন, জিঙ্ক, সেলেনিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, নায়াসিন, রিবোফ্ল্যাভিন, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন বি২ বি৩, বি৬, বি১২, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট। গরুর মাংসে সম্পৃক্ত ও অসম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ প্রায় সমান সমান থাকে। এতে উপস্থিত ফ্যাটি এসিডের মধ্যে রয়েছে স্টিয়ারিক এসিড, ওলিক এসিড ও পামিটিক এসিড।
৮৫ গ্রাম গরুর মাংসে রয়েছে ১৭৫ ক্যালরির মতো। এতে ৮টি প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিডের প্রত্যেকটিই থাকে, যা দেহের বৃদ্ধি এবং ক্ষয়পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের পেশি গঠনে, হাড়ের বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে এবং ওজন কমাতেও মাংস সাহায্য করে। কারণ অল্প পরিমাণ মাংসে বেশি প্রোটিন পাওয়া যায়। খাবারে তৃপ্তি আনে এবং অত্যধিক খাবারের প্রবণতা কমায়। এটি বিশেষ করে শিশুদের বৃদ্ধির জন্য দরকার। এতে থাকা আয়রন গর্ভবতী নারী, কিশোরী, বয়স্ক লোক ও শিশুদের হিমোগ্লোবিন চমৎকার উৎস।
বি ভিটামিনগুলোর উপস্থিতি মাংসে থাকায় তা স্নায়ুতন্ত্র ও চোখের উন্নতি সাধন, হজমে সাহায্য, চুল, ত্বক ও নখের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও বি কমপ্লেক্সের অভাবজনিত রোগ দূর ও ডিএন এ তৈরিতে সাহায্য করে।
মাংসে থাকা জিংক দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, রুচি বাড়াতে, ক্ষত শুকাতে, দেহের বৃদ্ধি এবং প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, কর্মোদ্যম বাড়াতে, পেশি, দাঁত ও হাড়ের গঠনে ভূমিকা রাখে। শরীরের বৃদ্ধি ও বুদ্ধি বাড়াতে, ক্ষত নিরাময় ও স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। ডায়রিয়া ও রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করে।
অতিরিক্ত গরুর মাংস খাওয়ার ঝুঁকি ও সতর্কতা:
* কিডনি ও উচ্চ রক্তচাপের রোগী এবং যাদের রক্তে কলস্টেরলের মাত্রা অনেক বেশি, তাদের মাংস যতটা সম্ভব কম খাওয়া উচিত।
কোষ্ঠকাঠিন্য বা পাইলস থাকলে খুব সামান্য পরিমাণে মাংস খেতে হবে। খেলেও তখন প্রচুর পানি, শরবত, ইসবগুলের ভুসি খেতে হবে।
* মাংসে অ্যালার্জি থাকলে এড়িয়ে যেতে হবে।
* হৃদরোগীরা ৫০ গ্রাম পর্যন্ত চর্বি ছাড়া মাংস খেতে পারবেন।
* টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়।
* আরথ্রাইটিস ও কিডনি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যায়।
* অতিরিক্ত মাংস খেলে পেটে বদহজম হয়, গ্যাস্ট্রিক এবং আলসারের সমস্যা বেড়ে যায়।
* অতিরিক্ত মাংস খেলে বৃহদন্ত্র, ক্ষুদ্রান্ত্র, পাকস্থলী, প্রোস্টেট, কোলন ও স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।
* যারা গরুর মাংস বেশি খান তাদের ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
* গরুর মাংসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম, যা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। আর উচ্চরক্তচাপ থেকে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনি জটিলতা দেখা দিতে পারে।
গরুর মাংস রান্নার ও খাবারের উপায়:
মাংস তেল-চর্বি ছাড়িয়ে নিয়ে ছোট ছোট টুকরা করে কেটে নিয়ে রান্নায় অবশ্যই কম তেল ও মসলা ব্যবহার করতে হবে। ঘি বা বাটারও কম ব্যবহার করতে হবে। ভুনা মাংস না খেয়ে বেক, গ্রিল বা ঝোল করে রান্না করে গোটা মাংস খাওয়াই ভালো এবং খাবার সময় সেই ঝোল এড়িয়ে যাওয়া। সবজি বা ডাল যেমন শালগম, বাঁধাকপি, ব্রকলি, বটবটি, শিম, পেঁপে, কচুর ছড়ি, মটরশুঁটি, বুটের ডাল, ক্যাপসিকাম দিয়ে রান্না করে খেলে চর্বির পরিমাণ অনেকটাই কমানো যায় এবং তা স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। তাতে কম ক্যালরি গ্রহণ করা হয়।
মাংসে থাকা ফ্যাট আরও কমাতে ভিনেগার, লেবুর রস বা টক দই দিয়ে রান্না করতে পারেন।
কুরবানির সময় স্বাভাবিকভাবেই মাংস একটু বেশি খাওয়া হয়। তাই এ সময় প্রোটিনসমৃদ্ধ অন্য খাবার এড়িয়ে চলুন। তবে চেষ্টা করতে হবে একটানা মাংস না খেয়ে কোনো বেলায় অন্য ধরনের সহজপাচ্য খাবার রাখার। মাংস দিয়ে যে রেসিপিই রান্না করা হোক না কেন তা অবশ্যই ওয়েল কুকড যেন হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
খাবারের ম্যাচিংটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মাংসের সঙ্গে ভাত, পোলাও বা বিরিয়ানি না রেখে লাল আটার রুটি, গ্রিল সবজি, সালাদ, রায়তা ইত্যাদি রাখতে হবে। এগুলো শরীরে চর্বি শোষণে বাধা দেয়। গ্রিল বা শিক কাবাব, জালি কাবাব পুড়িয়ে খাওয়ার কারণে ক্ষতির আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়। কার্বোনেটেড বেভারেজ অর্থাৎ কোক, পেপসি না খেয়ে বোরহানি, লাচ্ছি, তেঁতুলের জুস বা চিনি ছাড়া অন্য ফলের জুস খেলে ক্ষতিকর প্রভাব কমানো সম্ভব।
শওকত আরা সাঈদা (লোপা)
ডায়েটিশিয়ান অ্যান্ড ইন-চার্জ
পারসোনা হেলথ, ধানমণ্ডি, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর
কুরবানির মাংসের উপকারিতা ও ঝুঁকি